জলসেচ

কৃষিকাজের জন্য জল অপরিহার্য্য। কৃষিকাজ করার জন্য নদী, পুকুর, খাল, জলাশয় থেকে যে জল এনে কৃষি জমিতে দেওয়া হয় বা সেচন করা তাকে জলসেচ বলে। বর্তমানে ভারতের মোট জমির ৪৬% জলসেচের অন্তর্ভুক্ত।

ভারতের কৃষিতে জলসেচের প্রয়ােজনীয়তা :-কৃষিতে জলসেচের প্রয়ােজনীতার কারণগুলি হল---

  • মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা [Uncertainity of Rainfall] :-ভারতের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ বৃষ্টিপাত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে হলেও এই বৃষ্টিপাত অত্যন্ত অনিশ্চিত । এই বায়ু কখনাে নির্দিষ্ট সময়ের আগে আসে, আবার কখনও পরে আসে। কোনও বছরে প্রচুর মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যার সৃষ্টি হয় । আবার কোনও বছর মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ার জন্য খরা দেখা দেয় । মৌসুমি বৃষ্টিপাতের এই অনিশ্চয়তার জন্য উপযুক্ত সময়ে পরিমিত জল পাওয়ার জন্য জলসেচের প্রয়োজন হয় ।
  • শীতকালীন বৃষ্টিপাতের অভাব [Scarcity of Rainfall in Winter Season] :-দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বৈশিষ্ট্য অনুসারে শীতকালে তামিলনাড়ু উপকুল এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের কোনও কোনও অংশ ছাড়া ভারতে বৃষ্টিপাত হয় না । সেই জন্য শীতকালীন রবিশস্য চাষের জন্য ভারতে জলসেচের প্রয়োজন হয় ।
  • বৃষ্টিপাতের অসম বন্টন [Unequal Distribution of Rainfall] :-ভারতের সর্বত্র মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সমান নয়, উত্তর-পশ্চিম ভারত ও দাক্ষিণাত্য মালভূমির মধ্যভাগে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় এই সব অঞ্চলে কৃষি কাজের জন্য জলসেচের প্রয়োজন হয় ।
  • উচ্চ ফলনশীল শস্যের চাষ [Cultivation of High Yielding Variety ] :-বর্তমানে ভারতে প্রচলিত নানারকম উচ্চ ফলনশীল শস্যের চাষে হয় । উচ্চ ফলনশীল শস্যের চাষে প্রচুর জলের প্রয়োজন হওয়ায় ব্যাপক ভাবে জলসেচের প্রয়োজন হয় ।
  • মৃত্তিকার অসম ধারণ ক্ষমতা [Water Holding Capacity of Soils]:-ভারতের সব অঞ্চলে মৃত্তিকার জল ধারণ ক্ষমতা সমান নয় । রেগুর ও এঁটেল মাটির জলধারণ ক্ষমতা বেশি, পলি মাটির মাঝারি আবার ল্যাটেরাইট ও বালি মাটির জলধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত কম। যেসব অঞ্চলের মৃত্তিকার জল ধারণ ক্ষমতা কম, সেখানকার কৃষি কাজের জন্য জলসেচের প্রয়োজন হয় ।
  • বহু ফসলী চাষ [Multiple cropping] :-আজকাল বৈজ্ঞানিক কৃষি পদ্ধতিতে একই জমিতে বহু বার ফসল ফলানো যায় । একই জমিতে বছরে বহুবার ফসল ফলানোর জন্য কৃষি জমিতে সারা বছর ধরে সেচের জলের যোগান রাখা অপরিহার্য ।
  • ভারতে কৃষি জমির প্রয়োজন বৃদ্ধি [Extension of Agricultural Land] :-কৃষিজ দ্রবের চাহিদা পূরণের জন্য জলসেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের মাধ্যমে বর্তমানে পতিত জমিতেও চাষ করা সম্ভব হচ্ছে ৷

ভারতে জলসেচ পদ্ধতি :-ভূতত্ত্ব, ভূপ্রকৃতি, নদী ব্যবথা, জলবায়ু, ভৌমজলের ভাণ্ডার, মৃত্তিকা প্রভৃতির তারতম্যের কারণে ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে জলসেচ করা হয়। সেচকার্যে জলের উৎসগুলি হল ---- (১) নদীর জল, (২) খাল, পুকুর, হ্রদের জল এবং (৩) ভৌমজল। এই জলের উৎসগুলি থেকেই প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে সারা ভারতে জলসেচ করা হয় - (১) কূপ ও নলকূপ, (২) জলাশয়, (৩) সেচখাল।

  • কূপ ও নলকূপ :- ভারতের মােট সেচযুক্ত জমির প্রায় ৩৮% জমিতে কূপ ও নলকূপের মাধ্যমে জলসেচ করা হয়। উত্তর ভারতের যেসব এলাকায় পলিমাটি আছে , সেখানে বৃষ্টির জল মাটির স্তর ভেদ করে মাটির নীচে গিয়ে সঞ্চিত হয় । বহু জায়গায় ভূগর্ভের ওই জল বা ভৌমজল ( underground water ) কূপ ও নলকূপের মাধ্যমে তুলে এনে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয় । কূপ ও নলকূপের গভীরতা ভূগর্ভের জলস্তরের ওপর নির্ভর করে । জলস্তর যদি ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে তাহলে গভীরতা কম হয় । নলকূপ দু-ধরনের- (ক) গভীর ও (খ) অগভীর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মাধ্যমে নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভের জল তােলা হয়। সেচ সেবিত অঞ্ল :- গভীর পলিমাটির স্তরে ভৌমজল সঞ্জিত থাকায় উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ, অসম প্রভৃতি রাজ্যে এই পঞধতি তে জলসেচ করা হয়।
  • জলাশয়:-মােট সেচ সেবিত জমির ১৮% জমিতে পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। যে সকল অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি অপ্রবেশ্য শিলাস্তর দ্বারা গঠিত এবং কূপ, নলকূপ খনন করা সুবিধাজনক নয় সেখানে জলাশয়ের মাধ্যমে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে জলসেচ করা হয় । এছাড়া ভারতের যেসব অঞ্চলে নিয়মিত বৃষ্টিপাত হয় না , সেখানে জলাশয় নির্মাণ করে ও পুষ্করিণীতে জল জমিয়ে রাখা হয় এবং তারপর ডােঙা , পাম্পিং মেশিন প্রভৃতির সাহায্যে ওই জল ব্যাপকভাবে সেচকার্যে ব্যবহার করা হয় । দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ , কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুতে জলাশয় পদ্ধতির প্রচলন বেশি । এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ , ওড়িশা , অসম , বিহার , ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যে জলাশয়ের মাধ্যমে সামান্য জলসেচ করা হয় ।
  • সেচখাল :-মােট সেচসেবিত জমির ৪৪% জমিতে এই পদ্ধতিতে জলসেচ করা হয়। সাধারণত সমভূমি অঞ্চলেই এই পদ্ধতিতে জলসেচ করা হয়। সেচখাল দু-ধরনের -
    • প্লাবন খাল :- বর্ষার অতিরিক্ত জলকে বা জোয়ারের জলকে সেচের কার্যের ব্যবহারের করার জন্য নদীর সাথে যে খালের সংযোগ করা হয় তাকে প্লাবন খাল বলে ।
    • নিত্যবহ খাল :-নদীতে বাঁধ দিয়ে নির্মিত জলাধার থেকে যখন খাল কাটা হয় তখন তাকে নিত্যবহ খাল বলে। এই প্রকার খালে বারাে মাসই জল থাকে।

    সেচসেবিত অঞ্চল :- সমগ্র গঙ্গা সমভূমির প্রায় সকল স্থানেই এই পঞ্ধতিতে জলসেচ হয়। দক্ষিণ ভারতের নদী অবাহিকাগুলিতে এই পথধতিতেই জলসেচ করা হয়ে থাকে। ভারতের বিখ্যাত কয়েকটি খাল ও উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত খালগুলি হল-নিম্নগঙ্গা, উচ্চগঙ্গা, আগ্রা খাল, সারদা খাল প্রভৃতি। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থানের রাজস্থান খাল, বিহারের সােম ও ক্রিবেণী খাল, পশ্চিমবঙ্গের দামােদর খাল, অন্প্রপ্রদেশের গােদাবরী, কৃষ্মা বদ্বীপ খাল হল ভারতের উল্লেখযােগ্য সেচখাল। এছাড়াও মােট বাকি সেচসেবিত জমির ১২ শতাংশ জমিতে জলসেচ করা হয় সরাসরি নদী থেকে জল তুলে।

বহুমুখী নদী পরিকল্পনা

যখন অসংখ্য উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নদীকে পরিকল্পনার আওতায় আনা হয় তাকে বহুমুখী নদী পরিকল্পনা বলে। এর উদ্দেশ্যগুলি হল - (ক) বন্যা নিয়ন্ত্রণ, (খ) জলসেচ ব্যবস্থার উন্নতি, (গ) বিদ্যুৎ উৎপাদন, (ঘ) জলপথে পরিবহন, (ঙ) ভূমিক্ষয় রােধ, (চ) শিল্পে প্রয়ােজনীয় জল সরবরাহ ও পানীয় জলের জোগান, (ছ) মাছ চাষ, (জ) পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি। ভারতের প্রায় অধিকাংশ বড় নদীকেই বহুমুখী নদী পরিকল্পনার আওতাভুক্ত করা হয়েছে।

প্রধান বহুমুখী পরিকল্পনাগুলি হল -

  • ঝাড়খণ্ডও পঃবঙ্গের দামােদর নদের উপর দামােদর পরিকল্পনা
  • হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব ও হরিয়ানার যৌথ উদ্যোগে শতদ্রু নদীর উপর ভাকরা-না্গাল (ভারতের বৃহত্তম) পরিকল্পনা
  • অন্ধপ্রদেশ কৃষ্মা নদীতে নাগার্জুনসাগর পরিকল্পনা
  • গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশের নর্মদা পরিকল্পনা
  • অন্ধপ্রদেশ ও কর্ণাটকের যৌথ উদ্যোগে তুঙ্গভদ্রা পরিকল্পনা
  • উঃ প্রদেশের শােন নদীর উপর রিহান্দ পরিকল্পনা
  • উঃপ্রদেশ ও বিহার এর যৌথ উদ্যোগে গন্ডক পরিকল্পনা
  • বিহারের কোশী পরিকল্পনা
  • উড়িষ্যার মহানদীর হীরাকুঁদ পরিকল্পনা